শেরপুর জেলার প্রাচীন ইতিহাস

09/12/2011 08:02

প্রাচীনকালে শেরপুর ছিলো কামরূপ রাজ্যের অধীন। মোঘল আমলে ষোড়শ শতাব্দীতে সম্রাট আকবরের আমলে সুবে বাংলার সরকার বাজুহার (বিভাগ) ৩২টি পরগণার অন্যতম ছিলো ব্রহ্মপুত্রের উত্তর পূর্ববর্তী পরগণা দশকাহনিয়া বাজু। শেরপুর পৌরসভার দক্ষিণ সীমান্তে মৃগী নদী হতে জামালপুর ঘাট পর্যন্ত প্রায় ৮/৯ মাইল প্রশস্ত ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্ব নাম ছিল লৌহিত্য সাগর। নদের উভয় পাডে়র নিকটবর্তী লোকদের প্রায় সময়ই নৌকায় যাতায়াত করতে হত। তারা খেয়া ঘাটের ইজারাদারের সহিত যাতায়াত মাশুল হিসবে বাৎসরিক চুক্তি অনুযায়ী ১০(দশ) কাহন কডি় প্রদান করত। সে হিসেবেই এ অঞ্চলের নাম হয় দশকাহনীয়া। বাংলার নবাবী আমলে দশকাহনিয়া বাজুর জায়গীরদার গাজী বংশের শেরআলী গাজীর নামানুসারে এই দশকাহনীয়া বাজু’র নাম হয়- শেরপুর। বর্তমান গাজীর খামার ইউনিয়নের গিদ্দা পাড়ায় ফকির বাড়ীতে শের আলী গাজীর মাজার এবং নকলা উপজেলার রুনী গাঁযে় গাজীর দরগাহ অবস্থিত। ১৯৭৯ সালে শেরপুর মহকুমা, ১৯৮৪ সালে জেলায় উন্নীত হয়। তবে শেরপুর পৌরসভা স্থাপিত হয় ১৮৬৯ সালে।অষ্টাদশ শতাব্দীর সূচনায় ইংরেজ আমলে অবিভক্ত বাংলার সর্ববৃহৎ জেলা ময়মনসিংহের বৃহত্তম পরগণা ছিল শেরপুর। সেই সমযে়ই এর আয়তন ছিল ৭৮৯.২৫ বর্গমাইল। সে সময় শেরপুরের সীমা ছিলো উত্তরে তোড়ার পার্বত্য অঞ্চল ও আসামের গোয়ালপাড়া জেলা, দক্ষিণে আলাপ সিংহ ও পুখরিয়া পরগণা। দক্ষিণ ও পূর্বে সুসং পরগণা, পশ্চিমে রংপুর জেলার পাতিলাদহ পরগণা।শেরপুর জেলার বর্তমান আয়তন ১,৩৬৩ দশমিক ৭৯ বর্গ কি.মি    । এর উত্তরে গাডে়াপাহাড়, দক্ষিণে জামালপুর ও ময়মনসিংহ জেলা, পূর্বদিকে ময়মনসিংহ এবং পশ্চিমে জামালপুর জেলা। শেরপুরের ৫টি উপজেলায় ৫৪টি ইউনিয়ন ও ৪টি পৌরসভা রযে়ছে। উপজেলাগুলো হলো- নকলা, নালিতাবাড়ী, শেরপুর সদর, শ্রীবরদী ও ঝিনাইগাতী। শেরপুর জেলার বর্তমান লোকসংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। অধিবাসীদের মধ্যে মুসলমান এবং হিন্দুই প্রধান। তাছাড়া পাহাড়ী জনপদে আদিবাসী, গারো, খ্রিষ্টানও রযে়ছে।

শেরপুরের উত্তর ও উত্তর পূর্বের পাহাড়ী অঞ্চল ব্যতিরেকে সবটাই ছিল গভীর জঙ্গলে ঘেরা জলভূমি আর চরভূমি। ব্রহ্মপুত্র নদ বারবার তার গতি পরিবর্তন করে নতুন নতুন চর তৈরী করে শেরপুরের ভূ-প্রকৃতিকে পাল্টে দিযে়ছে। এইসব চরভূমি ধীরে ধীরে বসতি অঞ্চল হযে় শেরপুর পরগণার মধ্য, দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের জনবহুল গ্রাম ও শহর তৈরি করেছে। মোঘল আমলে চর-খাল বিলে পরিপূর্ণ এ অঞ্চলে ব্রহ্মপুত্র তখন এত চওড়া ও খরস্রোতা ছিলো যে, সেই নদী পার হযে় শেরপুর পৌঁছতে সময় লাগতো এক প্রহর বা তিন ঘন্টারও ওপর। আর এই নদী পারাপারের মাশুল ছিল দশ কাহন বা কডি়। পুরনো দলিল দস্ত্মাবেজে তাই এর উল্লেখ পাওয়া যায় দশকাহনিয়া বাজু (বিভাগ) হিসেবে।মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময় ব্রহ্মপুত্র নদ জামালপুর থেকে শেরপুরের শেরী নদী পর্যন্ত্ম বিস্তৃত ছিল। পরবর্তীতে প্রাকৃতিক নিয়মে ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রবাহ সরে যায় দক্ষিণের দিকে। কালক্রমে ব্রহ্মপুত্রের বুকে চর জেগে লছমনপুর, চরপাড়া, চরশেরপুর, মুচারচর, বয়রা, শীতলপুরসহ অনেকগুলো জনপদ ব্রহ্মপুত্র তথা শেরী নদীর বুকে আত্মপ্রকাশ করে। শেরপুরের দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তের মৃগী নদী ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকারূপে প্রসারিত ছিলো। পরবর্তীকালের ইচলি বিল এই অববাহিকারই অংশ। বর্তমানে চর এলাকার কোন কোনটির নামের পরিবর্তন ঘটেছে। পুরনো নাম হারিযে় যাচ্ছে। যেমন শহরের নবীনচরের নাম হযে়ছে নবীনগর। চরশেরপুর, চরপক্ষীমারী, লছমনপুর, জঙ্গলদী ব্রহ্মপুত্রের এসব চরভূমি প্রায় ৩’শ বছরের পুরনো। শেরপুরের উত্তরাংশে ছিল দুর্গম পার্বত্য ও অরণ্য। পাহাড়ী এসব উপত্যকায় ছিলো আদিবাসী কোচ, গারো, হাজং, রাজবংশি, হদি, বানাই, বর্মনদের বাস। বন্যহাতি, বনমহিষ, বাঘ, ভল্লুকসহ নানা হিংস্র সব জীবজন্তুর আবাস ছিলো এসব পাহাডে়। খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে শেরপুরের উত্তর ও উত্তর পূর্বাঞ্চলে আদিবাসী সামন্তর/পৃথক রাজত্ব কাযে়ম করেছিলো। গড়জডি়পা ছিলো তার অন্যতম। পঞ্চদশ শতাব্দির শেষভাগে সেসব সামন্তরাজের অবসান ঘটে।বর্তমানে শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার ৪২ কি.মি, দীর্ঘ ভারত সীমান্তজুডে় গাডে়াপাহাডে়র অবস্থান। লালমাটি আর পাথরের উঁচু-নীচু টিলার প্রাকৃতিক শাল-গজারীর পাশপাশি একাশি, মিনজিরাম, কড়ই, সেগুন, মেহগিনির বনবাগান সৃজন করা হযে়ছে। এখনো খাদ্যের সন্ধানে বন্যহাতি পাহাড় থেকে লোকালযে় নেমে এসে তান্ডব চালায়।

( সংগৃহিত )